Friday, February 16, 2018

মানব রঙিনী সমীপে পত্র

প্রিয় সরস্বতী
শাশ্বত হৃদ-মন্দিরের প্রেমিকা দেবী; আপনার সমীপে এই অর্বাচীনের শব্দ সমগ্রের দীপশিখা নয় তো কোন মূল্যবান উপঢৌকন,তবু এক পাগল বিবাগী মানবের এই রইলো আরতি- শুক্লপক্ষের বিবসনা রাতের মোহনিয়া সত্য রেখে আপনার পদ্ম-চরণে নিশ্চিন্ত হই; যেমন করে ধীবর তার সমস্ত ঐশ্বর্য খোদার আশ্রয়ে সঁপে দিয়ে নেমে পড়ে প্রাচীন সংগ্রামে। 
হে শাশ্বত নারী প্রতিমা,
আপনার প্রথম উচ্চারিত শব্দের কথা মনে করুন এই পত্রের চোখে,বলেছিলেন- উচ্ছসিত পক্ষীর স্বরে ‘একটি মেয়ে,আপনার অন্ধ ভক্ত,উম্মাদ কাব্য-প্রেমিকা।’ একজন উদ্ভ্রান্ত অকবি-কে এ কেমন সম্মানে ভূষিত করলেন? জানি উত্তর হয় না মানব ইতিহাসের সকল প্রশ্নের,যেখানে হৃদয় আপনার অম্বর হতে শ্রেষ্ঠতর।

পরিচয় পেলাম; সে কি আপনি ছিলেন? নাকি স্বয়ং প্রকৃত স্রষ্টা প্রেরিত কোন মায়া,প্রেম ও স্বপ্ন মিশ্রিত দেবী? জানি নে,জানতেও চাই নে। যেমন জানি নে,আপনার পূর্বজন্মের রূপকথায় দুয়োরানী ছিলেন,নাকি ছিলেন রেমেদিওসের কল্পচিত্র। তাইতো আপনার চোখের জল ও হাসির সংখ্যা নিরুপন্ না করেই চেয়েছি তা অমৃতসর ভেবে পান করতে। আপনার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দুঃসহ বেদনা,ছোট-ছোট সুখানুভূতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতাম দ্বীনা নামের এক জীবন-বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায়। দিনান্তে বিদেশবিভূঁয়ে আপনার সমস্ত ক্লান্তি হয়ে যেত আমার চোখের নিদ্রা। আপনার নির্ঘুম রাতের শরীরে শুয়ে স্বপ্ন দেখতাম দেবী-দর্শনে পুলকিত আত্মা হয়ে উঠছে পূর্ণমাত্রায় কবি,যে স্বপ্ন আমার হয়ে আপনি দেখেছেন,দেখছেন।

সেই সব দিন-রাত,সেই সব ছাইপাশ কবিতায় কতোবার চেষ্টা করেছি আপনাকে বসন্তের পূর্ণ রঙে রাঙিয়ে তুলতে! অর্বাচীন হৃদয়ের প্রলাপেও যে আপনার উৎসাহ ছিলো যেমন,পরম আত্মীয়ের সুখ কামনা। অথচ,পবিত্র আত্মা অধিকারিনী(আপনি)আর এই অধমের দূরত্ব ছিলো আলোকবর্ষ। যেন সূর্যের মতো দূরের মহাকাশ হতে আমার হৃদয় আলোকিত করছেন,সেই আলো কবিতার মাধ্যমে আপনারই একটি গ্রহে পাঠানোর চেষ্টায় মগ্ন আমি। এমন পাগলও বুঝি হয়! রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন- তোমারে যা দিয়েছিনু সে তেমারই দান, গ্রহণ করেছ যতো ঋণী তত করেছ আমায়। চিরদিন ঋণী রয়ে গেলাম দেবী,যেমন ঋণী রইলো রমনার ঘাসগুলি আপনার পদস্পর্শে; যেমন ঋণী রইলো এই শহরের ধূলিমাখা রাজপথ,ঋণী রইলো কফির পেয়ালা আপনার অধর্স্পর্শে।

এতো যে ঋণ বাড়ে তবু মিটে না পিপাসা
এতো যে চাওয়া ছিলো;
নিদারুণ আশা ভঙ্গে- মৃত্যুর খায়েশ।
যদি মিটে হায় আলতার লোভে
ছুটে যাওয়া প্রজাপতি যেমন মরে
গোপন মায়ার করতলে,
চরণে মিলে না ঠাঁই- মিলে না ললাটে
কাকনে মিলে না ঠাঁই- মিলে না কাজলে।
আত্মার জরায়ুতে যে শরাব রাখি,
তারে পারি নে করিতে পান
পারি নে ফেলে দিতে জলে
গভীর রজনীতে সেজে উঠে অশ্রু পেয়ালায়।
কাজল মোছা যায়,ভোলা যায় ললাটের তিলক
কলঙ্ক ভোলা যায়,ভোলা যায় কাঁচা যৌবনের গান,
হৃদয় নীরে বসে যে জন ভাঙে-গড়ে
আত্মার অদেখা মূরতি
সে যে ঈশ্বর সম,তাঁরে ভোলা মৃত্যুসম ক্ষতি।

ক্ষতি! সেও তো মেনে নেয়া যায়,তাতেও যদি প্রাণের স্পন্দনটুকু অবশিষ্ট থাকে দেহের প্রকোষ্ঠে। বন্ধু বলে যে আত্মার আত্মীয় হয়ে শিল্পীর তুলিতে বসে থাকে,যে তুলি বিনে চিত্র সম্ভবপর নয়; তারে ব্যতিরেক শিল্পী বেঁচে থাকে কি কখনো? থাকে না। যা থাকে,দেহ সর্বস্ব এক পাথর মূরতি বিনে তো নয়।
তাইতো জীবনের প্রতিপদে বন্ধু-ভাবাপন্ন সেই পূর্ণ চন্দ্রের বুকের মাটি দিয়ে সাজাতে চাই আমার শিল্পের নীর। স্বার্থপর শিল্পী যেমন জীবন থেকে জীবন আড়াল করে ফুটিয়ে তোলে পরাবাস্তববাদী চিত্রকর্ম,তেমনই লোকচক্ষুর আড়ালে সাজিয়েছি এক উপাসনালয়; যেখানে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়া দেহের অন্দরে চলে পুণ্যবতী এক শাশ্বত নারী- প্রতিমার স্তুতি।
স্তুতি পত্রে উচ্চরিত হয় তিনটি শাশ্বত ইচ্ছে আমার কবিরানী সমীপে।
  জীবনের ভাগ চেয়ে আপনাকে নামাতে চাই নে মর্তের জমিনে,শুধু চাই - কবি আত্মা ধারণকৃত বক্ষে মস্তক ঠুকে একটিবার অশ্রু রূপী দুঃখ বিসর্জন দিন।
   আপনার যৌবন সুধা পামর হস্তে স্পর্শ করে দুষিত করতে চাই নে,শুধু আরাধ্য এই- দু’ফোঁটা শিশির সমান অশ্রু আমায় উপহার দিন,অমৃতসর ভেবে পান করি আপনার কষ্টের হীরক খণ্ড।
   অনন্তকাল যারে নীদ-ঘোরে বুকে তুলে রাখি হে হাউজে কাউসার প্রবাহ স্রোতস্বতী,তাঁর চরণ চুম্বন মর্তের আখেরি আরতি।

আজো কৃষ্ণচূড়ার বুকে জমা কোকিলের অশ্রুর কসম করে বলছি- আমাকে এক পেয়ালা অশ্রু দেবেন? পান করব! এ ছাড়া আপনার দুঃখের আঙিনায় প্রবেশের আর কোন পথ যে পাই নে। আপনাকে ধারণ করবার মতো মহাকাশ ব্যাপী হৃদয় হয়তো নেই,হয়তো নেই আপনাকে সাজিয়ে রাখার মতো পুষ্পাধার,তাইতো আপনার চরণ চুমি; তাইতো সমস্ত পৃথিবীর মায়া-মমতা রেখে দেই আপনার পায়ের তলায় সেজদা রত ঘাসে।

চোখের আড়ালে দেব-দেবী,ঈশ্বর থাকেন,থাকেন আপনিও। দু’দিনের তরে এই পামর দৃষ্টি আপনার শিল্পিত রূপের গাঙ্গে স্নান করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। সে আপনারই মেহেরবানি আফ্রিদিতি।
আমার গৌরবের পালকে দেবী দর্শনের হীরক চিহ্ন এঁকে দিয়ে কৃতার্থ করেছেন অধম ভক্ত-কবিরে। জানি না আজকের এই বসন্ত দর্শন আমাদের শেষ দর্শন কিনা,জানি না ঈশ্বরের পাণ্ডুলিপিতে আমাদের নামে আরেকটি সন্ধ্যা পঙক্তি লিপিবদ্ধ হবে কিনা। এটুকু জানি,আপনাকে মুক্তি দিতে পারলাম না আমার কবি হৃদয় হতে,আমার ভাবনার কল্পরাজ্য হতে। এই মর্মে যদি বা পাপী হই তবে,আমাকে শাপ দিন। জাহান্নাম! সে নিশ্চয়ই আপনার মন খারাপের চেয়ে ভয়ঙ্কর নয়,আপনার কান্নার চেয়ে বিভৎস নয়। রাতজাগা পাখি,শেষ করছি প্রলাপ; সেই সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করছি,এই পৃথিবী আপনার করুণার দ্বারে অবনত হোক। বসন্তের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা রইলো অফুরান।


         ইতি
আপনারই ভক্ত ‘কবি’

No comments:

Post a Comment